ঝালকাঠি জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত, নামকরণ, দর্শনীয় স্থান এবং জেলার পরিচিতি

ঝালকাঠি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা যার মোট আয়তন ৭০৬.৭৭ বর্গ কিমি।২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঝালকাঠি জেলার মোট জনসংখ্যা ৬,৮২,৬৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩,২৯,১৪৭ জন এবং মহিলা ৩,৫৩,৫২২ জন।এ জেলার সাক্ষরতার হার ৬৬.৭%।ঝালকাঠী শহর ঢাকা থেকে ১৯৫ কি.মি. দক্ষিণে এবং বরিশাল বিভাগীয় শহর থেকে ২০ কি.মি. পশ্চিমে সুগন্ধা নদীর তীরে অবস্থিত।  এছাড়াও এই আর্টিকেলের আলোচ্য বিষয় হলো ঝালকাঠি জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত (Why Jhalkathi district is famous for), ঝালকাঠি জেলার বিখ্যাত ব্যক্তির নাম, ঝালকাঠি জেলার নামকরণ, ঝালকাঠি জেলার দর্শনীয় স্থান, ঝালকাঠি জেলার নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত।

ঝালকাঠি জেলার নামকরণ

ঝালকাঠি পূর্বে বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ঝালকাঠি থানাকে বরিশাল জেলা থেকে পৃথক করে পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত করা হয়। এই বিশাল বিশ্বের ভূখন্ডে প্রতিটি কিছুর নাম অকারণবশত পরিচিত হয়ে উঠেনি।কিছু না কিছু কারণেই নামগুলো প্রতিটি কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। অনেক লোককথা/ বাণী ও ইতিহাস পাওয়া যায় এসব নামের পেছনে।ঝালকাঠির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।

মধ্যযুগ-পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা, সুগন্ধা, ধানসিঁড়ি আর বিষখালী নদীর তীরবর্তী এলাকায় জেলেরা বসতি স্থাপন করে। এখানকার প্রাচীন নাম ছিল ‘মহারাজগঞ্জ’। মহারাজগঞ্জের ভূ-স্বামী শ্রী কৈলাশচন্দ্র জমিদারি বৈঠক সম্পাদন করতেন এবং পরবর্তীতে তিনি এ স্থানটিতে এক গঞ্জ বা বাজার নির্মাণ করেন। এ গঞ্জে জেলেরা জালের কাঠি বিক্রি করত। এ জালের কাঠি থেকে পর্যায়ক্রমে ঝালকাঠি নামকরণ করা হয় বলে ধারণা করা হয়।

ঝালকাঠি জেলার দর্শনীয় স্থান

প্রতিটি জেলায় কিছু না কিছু দর্শনীয় স্থান থাকেই। ঠিক তেমন ঝালকাঠি জেলার কিছু দর্শনীয় স্থান হলো –

  • সুজাবাদ কেল্লা
  • ঘোষাল রাজবাড়ী
  • পুরাতন পৌরসভা ভবন
  • মাদাবর মসজিদ
  • সুরিচোরা জামে মসজিদ
  • নেছারাবাদ মাদ্রাসা
  • গাবখান সেতু
  • কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি
  • শের-ই বাংলা ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ
  • বিনয়কাঠি

ঝালকাঠি জেলার বিখ্যাত ব্যক্তির নাম

প্রতিটি জায়গাকে তার নিজস্ব স্বত্তা ছাড়াও যারা আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন তারা হলেন ওই জায়গার উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিবর্গ গণ যারা উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের মাধ্যমে নিজের জন্মভূমির নাম ও স্মরণীয় করে রাখেন।ঝালকাঠি জেলার এমন কিছু ব্যাক্তিত্ব হলো –

➤কামিনী রায় -স্বনামধন্য কবি কামিনী রায়। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ।

➤ হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আযীযুর রহমান (কায়েদ সাহেব হুজুর) – তিনি দক্ষিন বাংলার একজন বিশিষ্ট পীর ও ঝালকাঠিবাসীর নয়নের মনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসাটি দক্ষিণ বাংলা তথা বাংলাদেশের একটি অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবগৌরবে মাথা উঁচু করে আছে।

➤. ডা. যামিনী সেন – (জুন ১৮৭১ – ১৯৩৩) ‘ফেলো অফ দি রয়াল ফ্যাকাল্টি অফ সার্জনস অ্যান্ড ফিজিশিয়ানশ’ উপাধিতে ভূষিত পৃথিবীর প্রথম মহিলা ডাক্তার

➤চণ্ডীচরণ সেন – (২৭ জানুয়ারি ১৮৪৫- ১০ জুন ১৯০৬) সাব-জজ, লেখক ও কবি কামিনী রায়ের পিতা।

➤অশোক গুহ – (১৯১১ – ১৯৬৫), বিখ্যাত অনুবাদক ও লেখক

➤তিতুরাম পুততুণ্ড – (অষ্টাদশ শতক), চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস লেখক শ্রীবৃন্দাবন পুততুণ্ডের পূর্ব পুরুষ, রাজা উদয়নারায়ণ কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত জ্যোতিষী

➤হজরত শাহ আহম্মদ – (ষোল শতকের শেষভাগ), বাগদাদ থেকে আগত সুফী সাধক।

➤দাউদ শাহ – (১৬ শতকের শেষভাগ) সুফি সাধক।

➤নকুলেশ্বর সরকার – (১৮৯৪ – ১৯৮৭), খ্যাতনামা কবিয়াল।

ঝালকাঠি জেলার বিখ্যাত খাবার

ঝালকাঠি লবণ ও আটার জন্য বিখ্যাত। প্রধান শস্য: ধান। প্রধান ফল: আম, কলা, জলপাই, কাঠাল তাল, লিচু, নারিকেল, আমড়া, পেয়ারা।

ঝালকাঠি কিসের জন্য বিখ্যাত

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে কবিতায় উল্লেখ্য স্বপ্নের ধানসিঁড়ি নদীর প্রবাহিত অঞ্চল হলো ঝালকাঠি। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জেলা। এই জেলায় রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার দৃশ্যময় স্থান।যা কেড়ে নেয় পর্যটকদের ভ্রমণপিয়াসী হৃদয়। ঝালকাঠি জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত দেখে নিন একনজরে-

সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি –

দক্ষিণ বাংলার ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা বরিশাল আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে রয়েছে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্মস্থান সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি (ঝধঃঁৎরধ তধসরহফধৎ ইধৎর)। ধারণা করা হয় ১৭শ শতকে ফজলুল হকের মাতামহ আলী মিয়া এ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ এবং এ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।

ভাসমান পেয়ারা বাজার –

ঝালকাঠি, বরিশাল এবং পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলিতে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান পেয়ারা বাজার। তিন দিক থেকে আসা খালের মোহনায় বসে ভিমরুলির এই ভাসমান পেয়ারা বাজার। জুলাই, আগস্ট পেয়ারার মৌসুম হলেও মাঝে মাঝে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজার চলে।খালের মধ্য দিয়ে চলার সময় চাইলে হাত বাড়িয়ে আমরা কিংবা পেয়ারা ধরতে পারবেন। আর যদি বৃষ্টি হয় তবে চারপাশটা আরো অপার্থিব সৌন্দর্যে মোহনীয় হয়ে উঠবে।

সুজাবাদ কেল্লা –

ঝালকাঠি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুগন্ধা নদীর পাড়ে সুজাবাদ কেল্লা (ঝঁলধনধফ কবষষধ) অবস্থিত। মোগল সাম্রাজ্যের শেষদিকে বাংলার এই অঞ্চল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অবাধ লুণ্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। শুধু তাই নয় এই জলদস্যুরা এক পর্যায়ে এই অঞ্চলে বসবাস করা নিরীহ মানুষ বিক্রি করার ভয়াবহ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

বিখ্যাত পর্যটক সেবাষ্টিয়ান ম্যান্ডরিক তৎকালীন তার ডায়েরিতে সেই ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনায় উল্লেখ করেন যে, পর্তুগিজ এবং আরাকানি জলদস্যুদের অসহনীয় উৎপাতের কারণে এই অঞ্চল জনশূন্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলের ত্রাস দুর্দমনীয় এই বাহিনীকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে শাহজাদা সুজা ষোলশ চুয়ান্ন সালে সুজাবাদ গ্রামের পত্তন করেন এবং জলদস্যুদের দমন এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সুজাবাদ গ্রামে দু’টি কেল্লা তৈরি করেন ।

কেল্লাদ্বয়ের একটি মাটি এবং অন্যটি ইট দ্বারা তৈরি করা। শাহ সুজা নির্মিত কেল্লাদ্বয় যথাক্রমে অন্দর এবং বাহির কেল্লা নামে পরিচিত ছিল।

জনশ্রুতি অনুসারে এই কেল্লা দু’টি একরাতের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল।

গাবখান সেতু –

বাংলার সুয়েজ খাল খ্যাত গাবখান চ্যানেলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ৫ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতুটিই গাবখান সেতু (এধনশযধহ ইৎরফমব) নামে পরিচিত। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম নৌপথ গাবখান চ্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ কিলোমিটার। দুইপাশে সবুজের সমারোহ নিয়ে বয়ে চলা এই খালটি সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশে অদ্বিতীয়।

প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন গাবখান চ্যানেলের নৌপথের রূপে বিমোহিত হওয়ার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করতে শতবর্ষী কোন প্যাডেল স্টীমারের ফ্রন্ট ডেকে চড়ে বসতে পারেন। গাবখান খালের ওপর নির্মিত গাবখান সেতুটি দেশের সর্বোচ্চ উঁচু সেতু হিসাবে স্বীকৃত।

ছৈলার ছর –

ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে কাঁঠালিয়া উপজেলায় যেতে পাড়ি দিতে হবে ৩৫ কিলোমিটার পথ। সেখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পরেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছৈলার চর। জানা যায়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার হেতালবুনিয়া গ্রামে বিশখালী নদীতে এক যুগেরও আগে ৪১ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে এক বিশাল চর। যা এখন ৬১টি একরে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ছৈলাগাছ থেকে চরটি পরিচিতি পেয়েছে ‘ছৈলার চর’ নামে। ছৈলা ছাড়াও এখানে কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বিশখালী নদীর তীরে জেগে ওঠা এই চরটি ‘ছৈলার চর নামে পরিচিত। পর্যটকদের মনে এটি একখণ্ড সুন্দরবন। নয়নাভিরাম এই চরটিকে ঘিরে দেখা দিয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা।

এ ই ঝালকাঠির আরও রয়েছে বিখ্যাত কিছু নদী যেমন –

  • কীর্তনখোলা নদী
  • খায়রাবাদ নদী
  • বিষখালী নদী
  • সুগন্ধা নদী
  • ধানসিঁড়ি নদী,
  • গাবখান নদী
  • জাংগালিয়া নদী ও
  • বাসন্ডা নদী।

এই অপার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েই একদিন কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার চরণে পরম অনুভবের সাথে রচিত করেন –

” আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *