সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ ও মুক্তির উপায়

সিজোফ্রেনিয়া জটিল একটি মানসিক ব্যাধি। এই রোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না৷ অর্থাৎ তারা পরিবার ও অন্যান্য সদস্যদের উপর অহেতুক সন্দেহ করে থাকে। সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উদ্ভট চিন্তা, বিভ্রান্তিকর বা অবাস্তব কিছু দেখা, অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা ইত্যাদি। সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে সচারচর অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন৷

আপনার বা পরিবারের কারো যদি এরকম কোন লক্ষণ হয়ে থাকে। তাহলে ভেবে নিতে হবে সিজোফ্রেনিয়া রোগ হয়েছে। যদিও এটা জটিল একটি মানসিক রোগ কিন্তু এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য বিভিন্ন রকমের উপায় রয়েছে। তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা মূলত এই সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ ও মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করি,আজকের আর্টিকেল মনোযোগ সহকারে পড়বেন।

সিজোফ্রেনিয়া রোগ কী

আপনাদের আগেই বলেছি সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল ধরনের মানসিক রোগ। অর্থাৎ এ সকল রোগের চিন্তাভাবনা সন্দেহমূলক হয়ে থাকে। পরিবারের সদস্যরা তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে বা তাকে হত্যা করতে পারে এরকম অহেতুক সন্দেহ করে থাকেন তারা। তাই এদেরকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় সিজোফেনিয়া রোগী বলা হয়।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ

সিজোফ্রেনিয়া যেহেতু একটি মানসিক রোগ। সেক্ষেত্রে এর লক্ষণ গুলো আপনাকে মানসিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তির এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তাকে মানসিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে,তার মধ্যে সিজোফেনিয়া রোগটা আছে কিনা। চলুন সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ সমূহ দেখে নেই।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের প্রধান লক্ষণ হল একা একা কথা বলা। অর্থাৎ এ সকল রোগীরা সব সময় নিজে নিজে কথা বলতে পছন্দ করে। তারা সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। পরিবারের সদস্য বা পরিচিত কেউ যদি কোন কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে তার উত্তর দিতে চায় না। পরিবারের বা পরিচিত কোন আত্মীয়-স্বজন তার ক্ষতি করতে পারে, এমন সন্দেহমূলক আচরণ সব সময় করে।

ধরুন আপনি সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত একজন ব্যক্তির কাছে খাবার নিয়ে গেলেন,সে ভাবতে পারে খাবার আপনি বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও তারা ভাবে পরিবারের সদস্যরা তাকে খুন করবে। সিজোফ্রেনিয়া রোগের অন্যতম লক্ষণ হল অহেতুক সন্দেহ করা।

একজন ব্যক্তি যখন এই রোগে আক্রান্ত হবে তার চিন্তাশক্তি অনেকটা কমে যাবে অর্থাৎ তার চিন্তা করার কোন ক্ষমতা থাকবে না। চিন্তা ধারার দিক থেকে সে অক্ষম হয়ে যাবে। রোগী অবাস্তব জিনিসকে সবার মাঝে বলতে শুরু করবে। অর্থাৎ, যে জিনিসটা কখনো হয়নি বা বাস্তবে নেই এমন জিনিস সে দাবি করে।

সিজোফ্রেনিয়া অন্যতম আরেকটি লক্ষণ হল পরিবার ও পরিজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করা। তাদের মেজাজ সব সময় খিটখিটে স্বভাবের থাকে। এছাড়াও আপনজনের প্রতি বেশি রাগ দেখায়। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে।

অযৌক্তিক কথাবার্তা মানে যে ঘটনা বাস্তবে কখনো সম্ভব হবে না। অথবা যে বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তি কোন দরকার নেই,এরকম কথাবার্তা তারা বলতে খুবই পছন্দ করে। এমন অনেক সিজোফ্রেনিয়া রোগী আছে যারা ঘুমে হাঁটাহাঁটি করে। অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে হাটাহাটি করা তাদের প্রধান একটি লক্ষণ।

সাংসারিক ও অফিসের কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। তারা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও যদিও কাজ করে সব সময় অমনোযোগী হয়ে থাকে। সাংসারিক ও অফিসে র কাজের অনিহার পেছনে অন্যতম কারণ হলো তাদের চিন্তাভাবনার অক্ষমতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ কাজটি কিভাবে করতে হবে সেই চিন্তা ভুলে গিয়েছে। এই কারণে তারা সকল কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

শুধু কাজের প্রতি আগ্রহ নয় জীবনের প্রতি আগ্রহ যেন তারা হারিয়ে ফেলে। কারণ তারা বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করতে শুরু করে। তারা পূর্বে যেভাবে জীবন যাপন করত,তা থেকে সম্পূর্ণ উল্টো ভাবে জীবন যাপন করতে শুরু করে। কারণ তাদের চিন্তাধারার বিঘ্ন ঘটেছে। তাই কিভাবে জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে হয় তা তাদের জ্ঞানের বাইরে।

এমন অনেক সিজোফ্রেনিয়া রোগী আছে যাদের বলতে শোনা যায় আমার মাথা ও পেটের মধ্যে পোকা কিলবিল করছে। অর্থাৎ তাদের মাথার মধ্যে পোকা দিয়ে ভরপুর আছে এরকম শব্দ বোঝায়। এটা থেকে বোঝা যায় তাদের মাথা ও পেট অত্যন্ত যন্ত্রণা করে।

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ

সত্যিকার অর্থে সিজোফ্রেনিয়া রোগের নির্দিষ্ট কোন কারণ এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বের করতে পারেনি। তবে কিছুটা ধারণা করা হয় জিনেটিক ও জৈব রাসায়নিক উপাদানের কারণে মূলত সিজোফ্রেনিয়ার রোগ হয়ে থাকে। যদি কোন পরিবারের বাবা-মা উভয়ের সিজোফ্রেনিয়া রোগ থাকে, তাহলে তার সন্তানের সিজোফ্রেনিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।

মস্তিষ্কে উপস্থিত কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ ডোপামাইন নামক উপাদানের ভারসাম্যহীনতার কারণে সিজোফ্রেনিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও অনেকে স্টেস কারণে এ রোগ হয়ে থাকে বলে দাবি করে। তবে এখন পর্যন্ত কোন মানসিক বিশেষজ্ঞ সিজোফ্রেনিয়া রোগের কারণ বের করতে পারেনি।

সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তির উপায়

মহান আল্লাহতালা যেমন পৃথিবীতে রোগ পাঠিয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে সেই রোগের প্রতিষেধক তৈরি করে দিয়েছেন। ঠিক তেমনিভাবে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। দিন দিন সিজোফ্রেনিয়া রোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এ রোগের বৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী। পূর্বের অনুচ্ছেদে সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ সম্পর্কে আপনি জানতে পেরেছেন এবার জানবেন এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে।

বর্তমান সময়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগের উন্নত চিকিৎসা রয়েছে। তবে এজন্য অবশ্যই একজন ব্যক্তির সিজোফ্রেনিয়া রোগ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। রোগের লক্ষণ যদি কোন ব্যক্তির সাথে মিলে যায়, তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ মানসিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করাতে হবে।

অনেক পরিবারে দেখা যায় রোগীকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয় না। কিন্তু অবশ্যই এরকম একটি জটিল মানসিক রোগীকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তারপর তাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচর্যা ও ওষুধ দিতে হবে।

তাহলে আশা করা যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ রোগ থেকে একজন ব্যক্তি মুক্তি লাভ করবে। যেহেতু সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক ব্যাধি, সেক্ষেত্রে আপনাকে দীর্ঘদিন ওষুধ সেবন করতে হবে। এমন অনেক রোগী আছে যারা তিন থেকে চার মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর,যখন ভালো হয়ে ওঠে তখন ঔষধ সেবন থেকে বিরত থাকে।

তারপর পুনরায় আবার তাদের এ রোগটি দেখা দেয়। এই কারণে আপনাকে দীর্ঘমেয়াদি একটি চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনাকে চলতে হবে। তাহলে দেখবেন এ রোগ থেকে ইনশাল্লাহ একদিন মুক্তি পাবেন।

আমরা সবাই জানি,কোন একটি রোগের প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধ করায় অনেক ভালো। এই কারণে আপনাকে অবশ্যই সিজোফ্রেনিয়া রোগীর পরিচর্যা করতে হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হবে তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে হবে। পরিবারের প্রধান দায়িত্ব হবে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের সবসময় পাশে থাকা। কারণ সব সময় এ রোগীরা একাকীত্ব অনুভব করে এবং সর্বোপরি আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়।

এছাড়াও আপনি সিজোফ্রেনিয়া গ্রুপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। এ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা হিসাবে আপনি এলাচ খেতে পারেন। এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো হ্রাস করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এলাচের গুঁড়া এক চা চামচ, এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।

সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির ভিটামিন ও মিনারেলের অনেক ঘাটতি থাকে। তাই বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে আপেল, আঙ্গুর,শাকসবজি,দুধ,ডিম,আমলকি,লালশাক ও খাসির মাংস খেতে হবে। তাহলে আপনার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ হ্রাস পেতে শুরু করবে।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের ওষুধ

সিজোফ্রেনিয়া থেকে আক্রান্ত রোগীদের মূলত নির্ধারিত , অ্যামিস্যান্ট ৫০ এম জি ট্যাবলেট (Amisant 50 MG Tablet) এই মানসিক ব্যাধিটির উপসর্গগুলিকে চিকিত্সা করে এবং এর অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে । এটি মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পদার্থ পরিবর্তন করে যাতে সিজোফ্রেনিক রোগীদের আচরণ ও চিন্তাভাবনা উন্নত হয় । 

সিজোফ্রেনিয়ার হোমিও ঔষধ

ড্রাগ গ্রুপ এ্যাটিপিক্যাল এন্টিসাইকোটিকসের সাথে সম্পর্কিত, কিউপেক্স ২০০ এম জি ট্যাবলেট (Qupex 200 MG Tablet) বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া বা বিষণ্নতা সম্পর্কিত লক্ষণগুলি চিকিত্সা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ঔষধ মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে কাজ করে।

তবে আপনি যদি সিজোফ্রেনিয়ার হোমিও ঔষধ সম্পর্কে বিস্তারিত আরও তথ্য জানতে চান তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর সাথে যোগাযোগ করবেন।

পরিশেষে কিছু কথা: এই ছিল আজকে সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ ও মুক্তির উপায় নিয়ে আমাদের একটি টিউটোরিয়াল। আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্য যদি সিজোফ্রেনিয়া রোগ হয়ে থাকে। তাহলে হতাশ না হয়ে,আপনি এ রোগ থেকে মুক্তির উপায় অবলম্বন করুন। তাহলে দেখবেন ইনশাল্লাহ সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *